সুনামগঞ্জের ছাতকের বধ্যভূমি 'শিখা সতের'র মূল তথ্য আজও অজানা রয়ে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে শিখা সতের এখানের মানুষকে আজও প্রেরণা দিয়ে যাচ্ছে। প্রতি বছর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে শত শত মানুষ ফুলেল শুভেচ্ছা জানাতে এখানে সমবেত হন। '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে সুনামগঞ্জের ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ সড়কের পশ্চিম পাশে মাধবপুরের লালপুর নামক স্থানে দেশের মুক্তিকামী ১৭ জন দামাল ছেলেকে পাকহানাদার বাহিনীর নরপশুরা এখানে জীবন্ত কবর দিয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেই নাম না জানা এসব যুবকের দেশপ্রেমের কাছে বাঙালি জাতি আজও নতশির। স্বাধীনতার পর এ স্থানটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে।
ছাতক মুক্তিযোদ্ধা সংসদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে আনুমানিক আগস্ট-সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ১৮ জন যুবক দেশপ্রেমে উৎসাহিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে সমবেত হন। তারা সুনামগঞ্জের সুরমা নদী পথে ছাতকের নোয়ারাই হয়ে ভারতের চেলা এলাকায় ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। নোয়ারাইয়ের বেতুরা এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় কুখ্যাত রাজাকার, স্থানীয় চেয়ারম্যান ফরিদ মিয়া ওরফে ফকির ও তার সহযোগী রাজাকাররা এই মুক্তিপাগল যুবকদের বোকা বানিয়ে হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। মুক্তিকামী এসব যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারত যাচ্ছেন জেনে রাজাকার ফকির চেয়ারম্যান তাদের ধোঁকা দিয়ে তার বেতুরা গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেবে বলে ফকির চেয়ারম্যান যুবকদের ধোঁকা দেন। তার মিষ্টি কথায় সরল বিশ্বাসে যুবকরা ট্রেনিংয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করতে থাকে। এ সময় নররাক্ষস ফকির চেয়ারম্যান পাক হানাদার বাহিনীকে খবর দিয়ে এনে টগবগে এসব যুবককে পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেন। যুবকরা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের হাত-পা বেঁধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে তোলে দিলে তাদের ছাতক থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় ছাতক বাজারের বাসিন্দা জাফর আহমদ কাবেরী নামের এক যুবক পালাতে সক্ষম হন। তিনি বর্তমানে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। ঐ দিন বেঁধে রেখে তাদের রাতভর অমানবিক নির্যাতন করা হয়। ঐ সময় ছাতক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন সিদ্দিকুর রহমান। পরের দিন সন্ধ্যায় ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ সড়কের লালপুল নামক স্থানে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। পরে স্থানীয় কতিপয় লোককে দিয়ে এখানে একটি বড় গর্ত খনন করানো হয়। মুক্তিপাগল যুবকদের আর্তচিৎকারে সে দিন দিগন্তে প্রতিধ্বনি হতে থাকে। আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তাদের কান্নার প্রতিধ্বনি। ভারি হয়ে উঠে এলাকার বাতাস। মুহূর্তের মধ্যে গর্জে উঠে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মেশিনগান। তাজা রক্তে রঙিন হয়ে উঠে লালপুল এলাকার সবুজ ঘাস। টেনে হেঁচড়ে তাদের যখন গর্তের মধ্যে ফেলে দেয়া হয় তখনও কারো মৃত্যু নিশ্চিত হয়নি। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় জীবন্ত ১৭ জন দামাল যুবককে নিমর্মভাবে মাটিচাপা দিয়ে নরপশুরা উল্লাসে মেতেছিল। সেই সাথে দেশের আরো ১৭ জন সূর্যসন্তানের এখানে জীবন্ত সমাধি রচিত হয়। যা আজ ছাতক তথা দেশের মানুষের কাছে 'শিখা সতের' নামে পরিচিত। ছাতক-গোবিন্দগঞ্জ সড়কের পশ্চিম পাশে ১৭ জন মুক্তিকামী যুবকের স্মৃতি নিয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে শিখা সতের।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস